আমাদের দেশে সচেতন বিনিয়োগকারীগণ কোন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়ের সময় সাধারনভাবে নানা বিষয়, যেমন-
আর্ণিংস পার শেয়ার (ইপিএস),
প্রাইস-আর্ণিংস (পি-ই) রেশিও,
ডেট-ইক্যুইটি রেশিও,
স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং পারসেন্টেজ,
রেভেনিউ গ্রোথ,
ইত্যাদি বিবেচনা করে থাকেন। কিন্ত তাঁরা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রায়ই ওভারলুক করে থাকেন, যেটা হলো ফ্রি ক্যাশ ফ্লো ( Free Cash Flow)। বাস্তবে কোন কোম্পানীর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা অনুধাবনের জন্য ফ্রি ক্যাশ ফ্লো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী একটি নির্দেশক। কারণ ইপিএস নয় বরং ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হচ্ছে শেয়ারহোল্ডারদের প্রকৃত আয়। ইপিএস এর হিসাবে প্রপার্টি, প্লান্ট ও ইকুইপমেন্ট (পিপিই) রক্ষনাবেক্ষণ বাবদ খরচ, যেটা ব্যবসা পরিচালনার জন্য আবশ্যক, সেটা অন্তর্ভূক্ত করা হয় না।
উদাহরণস্বরুপ, অনাদায়যোগ্য কিন্ত বাকীতে বিক্রিত পণ্যের বিপরীতে ইপিএস বাড়তে পারে, যদিও তা কোম্পানীর সুস্বাস্থ্যের পরিচায়ক নয় এবং ক্যাশ ফ্লো’তে তা জমা হবে না। তাই, ফ্রি ক্যাশ ফ্লো’কে ধরা যায় পৃকত নগদ আয় যা কোম্পানী শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ হিসাবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়।
ফ্রি ক্যাশ ফ্লো বিবেচনায় অবহেলার অন্যতম কারণ হলো যে দেশের প্রচলিত সিকিউরিটিজ আইনানুযায়ী পাবলিকলি লিষ্টেড কোম্পানীকে তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে (বার্ষিক, অর্ধ-বার্ষিক, ত্রৈমাসিক) তা উল্লেখ করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিটি লিস্টেড কোম্পানীকে নিজ ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বার্ষিক, অর্ধ-বার্ষিক, ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন আপলোড করতে হয়। বিদ্যমান আইনানুযায়ী সেসব প্রতিবেদনে কোম্পানীর ব্যালেন্স সীট, ইনকাম স্টেট্মেন্ট ও ক্যাশ ফ্লো স্টেট্মেন্ট থাকে। কিন্ত সেখানে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য যেমন- নীট আয়, ইপিএস,ব্যাংক ঋণ, শেয়ার প্রতি ক্যাশ ফ্লো, ইকুইটির পরিমাণ, ইত্যাদি উল্লেখ করার আবশ্যকতা থাকলেও ফ্রি ক্যাশ ফ্লো অবস্থা জানানোর কোন আবশ্যকতা নেই। ফলে সংগত কারণেই বাংলাদেশের কোম্পানীগুলো তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করে না। তাই প্রতিবেদনের বিভিন্ন অংশে বর্ণিত সংখ্যা থেকে হিসাব করার মাধ্যমে তা বের করতে হয়, যা অনেকেই ঝামেলার বিষয় মনে করেন। অথচ বিনিয়োগকারীগণ একটু সচেতন হলে সহজেই আর্থিক প্রতিবেদন থেকে তা বের করে নিতে পারেন।
ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হিসাব পদ্ধতিঃ কোম্পানীর ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্টের প্রথম অংশ অর্থাৎ Cash Flow from Operating Activities যদি পজিটিভ হয় তবে তা থেকে Cash Flow from Investing Activities অংশে বর্ণিত প্রপার্টি, প্লান্ট ও ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বাবদ যে পরিমাণ খরচ করা হয়েছে তা বাদ দিলে প্রাপ্ত পরিমাণই হচ্ছে কোম্পানীর মোট ফ্রি ক্যাশ ফ্লো। তারপর সেই পরিমাণ অর্থকে শেয়ারসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই শেয়ারপ্রতি ফ্রি ক্যাশ ফ্লো পাওয়া যাবে। ধরা যাক, অপারেটিং কার্যক্রম থেকে নীট ক্যাশ আয় হয়েছে ১০ লাখ টাকা এবং কোম্পানীর ফ্যাক্টরী ও অফিস বিল্ডিং এবং মেশিনারী রক্ষনাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হয়েছে ২ লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হবে ৮ লাখ টাকা। এখন কোম্পানীর মোট শেয়ার সংখ্যা ১ লাখ হলে শেয়ারপ্রতি ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হবে ৮ টাকা।
ফ্রি ক্যাশ ফ্লো এর ব্যবহারঃ ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হচ্ছে ওনার্স তথা শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটি। সে অর্থ দিয়ে ম্যানেজমেন্ট তথা দায়িত্বরত উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদেরকে ডিভিডেন্ড দিতে পারে কিংবা কোম্পানীর ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারে। এখন ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ফলে ভবিষ্যতে সুদ বাবদ খরচ কমবে যার ফলে নীট আয় বৃদ্ধি পাবে এবং বেশী করে ল্ভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হবে। এটা অনেকটা বর্তমান বনাম ভবিষ্যত ভোগের মধ্যে ট্রেড-অফ। ফ্রি ক্যাশ ফ্লো এর অর্থ দিয়ে শেয়ার বাই ব্যাকও করা যায়, যাতে করে আগামী দিনে কম শেয়ারের কারণে শেয়ারপ্রতি আয় বেশী হবে। তবে ফ্রি ক্যাশ ফ্লো’র অর্থ কোন্ কাজে ও কি অনুপাতে কোথায় খাটানো হবে তার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে কোম্পানীর ম্যানেজমেন্টের উপর। ফ্রি ক্যাশ ফ্লো কোম্পানীর ব্যবসা ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে সঠিকভাবে ব্যবহারের বিষয়টি ম্যানেজমেন্টের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। তবে সাধারন বিনিয়োগকারীকে নিজ স্বার্থেই দেখতে হবে কি পরিমাণ ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হচ্ছে এবং ম্যানেজমেন্ট তা কোন্ কাজে কি অনুপাতে ব্যবহার করছে। যদি দেখা যায় যে, কোম্পানীর পেইড আপ ক্যাপিটাল এর তুলনায় ফ্রি ক্যাশ ফ্লো এর পরিমাণ নগণ্য এবং কোম্পানীর দায় হিসেবে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ আছে তবে সে কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় না করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আবার যদি দেখা যায় যে, যে পরিমাণ ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হলো তার চেয়ে বেশী ডিভিডেন্ড দেয়া হলো তবে সম্ভবত তা ব্যাংকের অর্থায়নে করা হয়েছে এবং যেটি কোম্পানীর আগামী দিনের ইপিএস বা ডিভিডেন্ড কমিয়ে দিবে।
সন্তোষজনক ফ্রি ক্যাশ ফ্লো রয়েছে এমন কোম্পানীতে বিনিয়োগ করা অনেকটাই নিরাপদ। লেখকের হিসাব মোতাবেক বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে সেক্টরভেদে কোম্পানীগুলোর মধ্যে ফ্রি ক্যাশ ফ্লো পরিমাণে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে সাম্প্রতিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ফার্মা খাতে রেনেটা ও স্কয়ার ফার্মা; ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিএসআরএম লিঃ, সিংগার বিডি ও বিবিএস ক্যাবলস; ফুড এন্ড এলাইড খাতে ইউনিলিভারসিএল, ব্যাটবিসি, অলিম্পিক, প্রাণ ও এপেক্স ফুড; ফুয়েল এন্ড পাওয়ার খাতে লিন্ডেবিডি, ইউপিজিসিএল এবং এসপিসিএল; ব্যাংকিং খাতে ট্রাষ্ট, এক্সিম, ব্র্যাক, ব্যাংক এশিয়া ও ডাচ-বাংলা; আইটি খাতে জেনেক্সিল ও ড্যাফোডিল কম্পিটার; এবং মিসসিলিনেওয়াস (বিবিধ) খাতে আমান ফিড ও বিএসসি কোম্পানীগুলোর সন্তোষজনক ফ্রি ক্যাশ ফ্লো রয়েছে বলে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি বিগত বছরগুলোতে গড়ে শেয়ারপ্রতি কোম্পানীর কি পরিমাণ ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হয়েছে তা বের করা হয় এবং সে মোতাবেক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
পরিশেষে বলবো যে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে নানাবিধ কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগণের বড় অংশ নিজ পুঁজি হারিয়েছেন বা এখনো হারাচ্ছেন। তাই তাঁদের উচিত হবে যথেষ্ট জেনে বুঝে সচেতনতার সাথে বিনিয়োগ করা। আর সে সচেতনতার অংশ হবে যেসব কোম্পানীর ফ্রি ক্যাশ ফ্লো সন্তোষজনক সেখানে বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ রাখা। সেরুপ স্ট্র্যাটেজীই বিনিয়োগ সুরক্ষা দিতে এবং তীব্র প্রতিযোগিতামূলক শেয়ার মার্কেটে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টিকে থাকতে সহায়তা করতে পারে।
Disclaimer: বর্ণিত কোম্পানীগুলোর ফ্রি ক্যাশ ফ্লো হিসাব করতে পাবলিক ড্যাটা ব্যবহার করা হয়েছে। আর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোম্পানীগুলো সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত যার সাথে বাস্তবের মিল নাও থাকতে পারে। তাই সেসব মন্তব্যের ভিত্তিতে কোন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয় থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা যাচ্ছে। অন্যথায় কারো ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতির জন্য কোনক্রমেই StockNow দায়ী থাকবে না।