Categories
জিজ্ঞাসা

শেয়ার ব্যবসায় ফান্ডামেন্টাল না টেকনিক্যাল এনালাইসিস করবেন?

বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বর্তমানে অন্তত কিছু গতি রয়েছে। মাস চার’এক আগেও বিনিয়োগকারী, ব্রোকার হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং এমনকি রেগুলেটরী সংস্থাগুলো পর্যন্ত সকল অংশীজনেরা ছিল চরমভাবে হতাশ। দীর্ঘদিন ধরে বাজার মন্দা থাকার কারণে ছিল সে হতাশা।

কিন্ত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে বাজারে গতি ফিরে আসতে শুরু করে। বিগত ১৯ জুলাই ২০২০ তারিখে ডিএসইএক্স ইন্ডেক্স যেখানে ছিল মাত্র ৪০৫১, সেটা বিগত দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৫০১১ এরও বেশী। অবশ্য বর্তমানে সূচক ৪৮০০ এর কাছাকাছি। দীর্ঘদিন পরে ডিএসইতে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে সন্তোষজনক পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে। বাজারে অনেক নতুন বিনিয়োগকারী ঢুকছে এবং পুরাতন কিন্ত নিস্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হচ্ছেন। সেসব নতুন ও কম অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই দারুণ বিভ্রান্তিতে থাকেন। তাঁরা কোন ধরনের এনালাইসিসের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। তাঁরা কি ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করবেন, না টেকনিক্যাল এনালাইসিস তাঁদের জন্য ভাল হবে সেটা নিয়েই অনেকে দোদুল্যমানতায় পড়েন।

প্রত্যকেই শেয়ার কেনে লাভের আশায় তথা ভবিষ্যতে দাম বৃদ্ধির প্রত্যাশায়। কথা হলো দাম যে বাড়বে তা কি করে বুঝা যাবে? সত্যিই এটা নিশ্চিতভাবে বুঝার কোন যাদুমন্ত্র নেই। সাধারনতঃ সচেতন সকল বিনিয়োগকারী মার্কেট বা কোম্পানী এনালাইসিস করেই শেয়ার কেনে কিংবা বিক্রি করে। কোম্পানীর নিকট অতীতের লাভ-লোকসানসহ আর্থিক অবস্থান,ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি এবং সেক্টর তথা কোম্পানীর সম্ভাব্য ভবিষ্যত অবস্থা বিশ্লেষণ করার পর শেয়ারটির অন্তর্নিহিত মূল্য (ইন্ট্রিন্সিক ভ্যালু) যদি বাজারমূল্য থেকে বেশী হয় তবে শেয়ারটি কেনা হয়। সেরুপ বিশ্লেষণই হলো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস। এরুপ বিশ্লেষণে কোম্পানীর ফাইনান্সিয়াল ড্যাটা, ইন্ডাষ্ট্রি ট্রেন্ডস, প্রতিযোগী কোম্পানীর পারফরমেন্স এবং ইকোনমিক আউটলুক এর সাহায্য নেয়া হয়।

আর যদি সেসবের কোন কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ না করে শুধুমাত্র বিগত সময়ের শেয়ার প্রাইস এবং ভ্লিউম এর ট্রেন্ড বা ধারা চার্টের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে সে প্রক্রিয়াকে টেকনিক্যাল এনালাইসিস বলে। ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল -দু’রকম এনালাইসিসেরই জনপ্রিয়তা আছে। আছে নিজস্ব সুবিধা কিংবা দূর্বলতা। উভয় পদ্ধতিতেই আগামী দিনে শেয়ারের সম্ভাব্য দাম কিরুপ হতে পারে সে সম্পর্কে অনুমান করার চেষ্টা করা হয়।

ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিসে যা দেখা হয়ঃ কোম্পানীর আর্থিক ভিত্তি কতটা মজবুত কিংবা ভংগুর, মূল্ধন ভিত্তি, ব্যাংক ঋণের পরিমাণ, কোম্পানী প্রডাক্টসের মার্কেট শেয়ার্, শেয়ারপ্রতি আয়, রিজার্ভের পরিমাণ, ডিভিডেন্ড পলিসি, স্পন্সরদের ইন্ট্রিগ্রিটি, ইত্যাদি নানা তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। সে বিশ্লেষণের জন্য প্রায়োজন হয় কোম্পানীর বার্ষিক, অর্ধবার্ষিক, ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন (ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টস), সময়ে সময়ে প্রকাশিত কোম্পানীর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য, এজিএম এ ম্যানেজমেন্টের বক্তব্য, সংবাদপ্ত্র ও মিডিয়ায় প্রকাশিত কোম্পানী সম্পর্কিত তথ্য ও পূর্বাভাস। কোম্পানীর আর্থিক প্রতিবেদনগুলোতে নানা তথ্য থাকে। থাকে নানা রকমের আর্থিক রেশিওর উল্লেখ; যেমন- ডেবিট-ইকুইটি, রিটার্ন ও এস্টেস, রিটার্ন ও ইকুইটি, ইত্যাদি।

এর বাইরেও প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট সংখ্যা ব্যবহার করে বিশ্লেষণকারী তার প্রয়োজন মোতাবেক নানা ধরনের রেশিও ক্যাল্কুলেট করতে পারেন; যেমন-ফ্রি ক্যাশ ফ্লো রেসি, ইনকাম রেসি, প্রাইস এয়ার্নিংস গ্রোথ রেসি, প্রাইস বুক ভ্যালু রেসি, ইত্যাদি। আর্থিক প্রতিবেদনের প্রধান ৩টি অংশ অর্থাৎ ব্যালেন্স সীট, ইনকাম স্টেট্মেন্ট ও ক্যাশ ফ্লো স্টেট্মেন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট সংখ্যা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় সেসব রেশিও সহজেই ক্যাল্কুলেট করা যায়।

ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এর সুবিধা অসুবিধাঃ এরুপ বিশ্লেষণে কোম্পানীর ফাইনান্সিয়াল ও ম্যানেজেরিয়াল এ্যাসপেক্টসের নানা দিকে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে যা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হয়। বিশ্লেষণ সঠিকভাবে করতে পারলে তা কোম্পানীর আগামী দিনের অবস্থান বা ভিত্তি সম্পর্কে অনেকটাই সঠিক ধারনা দিতে পারে। আর বিশ্লেষণ সঠিক হলে ভবিষ্যতে যেসব কোম্পানীর আয় ও দাম বাড়বে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।

ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এর বড় দূর্বলতা হলো এটি যথেষ্ট কস্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এ বিশ্লেষণ করতে অনেক বিষয়ের উপর নজর রাখতে হয় এবং নানাধরনের চলক (ভেরিএবলেস) এর মধ্যকার সম্পর্কের ধরণ বিবেচনা করতে হয়। তদুপরি সে বিশ্লেষণ স্বল্পমেয়াদে তেমন কাজে দেয় না এবং মার্কেট এন্ট্রি বা এক্সিট সম্পর্কে ধারনা দেয় না। একটা কোম্পানী তা যত মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন হউক না কেন, যদি মার্কেট সূচক অত্যধিক উচ্চ (বাবল) অবস্থায় তা ক্রয় করা হয় তবে তার রিটার্ন অন্ততঃ স্বল্পমেয়াদে নেগেটিভ হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস খুবই সহায়ক একটি টুলস।

টেকনিক্যাল এনালাইসিসে যা দেখা হয়ঃ শুধুমাত্র বিগত দিনে কোম্পানীর প্রাইস ট্রেন্ড এবং কিছুক্ষেত্রে ট্রেড ভ্লিউম কিরুপ ছিল তা দেখা হয়। এখানে অতীতের লাভ-লস, আর্থিক ভিত্তি, ম্যানেজমেন্টের অবস্থা, ডিভিডেন্ডের তথ্য -কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। কারণ টেকনিক্যাল এনালিষ্টরা বিশ্বাস করে যে কোম্পানীর আর্থিক অবস্থানের চিত্র, এমনকি প্রাইসের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন সকল ইনফরমেশন, ইতিমধ্যেই শেয়ারপ্রাইসে প্রতিফলিত হয়ে গেছে।

তাই প্রাইসের ট্রেন্ড দেখেই শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে তারা মনে করেন। সে ট্রেন্ড বুঝতে নানারকম চার্টের সাহায্য নেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশের ফলে রিয়েল টাইম প্রাইসের ভিত্তিতে নানারকম আকর্ষনীয় রংয়ে যে কোন কোম্পানীর চার্ট মূহুর্তেই তৈরী করা সম্ভব যার উপর নির্ভর করে ট্রেডিং সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। এযাবত অসংখ্য রকমের টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর ও চার্ট উদ্ভাবিত হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নোক্ত চার্টগুলো অধিকতর জনপ্রিয়ঃ সিম্পল মুভিং অ্যাভারেজ, মুভিং অ্যাভারেজ কোনভার্জেন্স দিভার্জেন্স (এমএসিডি), বোলিংগার ব্যান্ডস, রিলেটিভ স্ট্রেংথ ইনডেক্স (আরএসআই), ইচিমোকু ক্লাউড, অ্যাভারেজ ডিরেক্শনাল ইনডেক্স (এডিআই) এবং মানি ফ্লো ইনডেক্স।

টেকনিক্যাল এনালাইসিস এরসুবিধা অসুবিধাঃ
এরুপ এনালাইসিস এর বড় সুবিধা হলো একমাত্র প্রাইস আর ভলিউম বাদে অন্যসব তথ্যের দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর টেকনিক্যাল চার্টের ব্যবহার একবার ভাল্ভাবে শিখে নিতে পারলেই এন্ট্রি এক্সিট সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় এবং তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভবান হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। মার্কেটের প্রাইস ডাটা চার্টে ফিট করে এন্ট্রি/এক্সিট সিগন্যাল পাওয়া যায়। মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক এমনকি মিনিট ভিত্তিতেও চার্ট দেখা যায়।

তার ফলে বিনিয়োগকারী তার নিজ ট্রেডিং স্টাইলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবেন যে তিনি কোন সময়ের ড্যাটা চার্টে ব্যবহার করবেন। যারা ডে ট্রেডার (ডে ট্রেডের) বা শর্ট টার্ম ট্রেডিং করে, দীর্ঘমেয়াদে শেয়ার ধরে রাখে না এবং ঘন ঘন ট্রেড করে, তারা স্বল্প সময়ের চার্ট দেখবেন। তাঁদের জন্য টেকনিক্যাল এনালাইসিস বিশেষভাবে উপযোগী। তবে টেকনিক্যাল এনালাইসিস এর দূর্বল দিক হলো যে এটি যতটা না বিজ্ঞাননির্ভর তার চেয়ে বেশী কলানির্ভর (আর্ট)। কারণ একই চার্টকে একেকজন এক এক দৃষ্টিতে দেখে। আর তার দেখার উপরই নির্ভর করে বাই কিংবা সেল সিগন্যাল। একজনের চোখে যেটা বাই সিগন্যাল অপরজনের চোখে সেটাই সেল সিগন্যাল মনে হয়। টেকনিক্যাল চার্ট সম্পর্কে জ্ঞানের গভীরতায় পার্থক্য এবং নিজ দৃষ্টিভংগীর ভিন্নতার কারণে এটি হয়।

তাছাড়া, অতীতের দামের ট্রেন্ডের সাথে ভবিষ্যতের দাম বা ট্রেন্ড মিলবে সেটা নাও হতে পারে। হঠাত কোন ধরনের শক হলে টেকনিক্যাল চার্ট নাও কাজ করতে পারে। সর্বোপরি, দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল এনালাইসিস তেমন সহায়ক নয়। এসব নানাবিধ কারণে সকল একাডেমীশিয়ান এবং সেইসাথে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিসে বিশ্বাসী বিশ্লেষকরা টেকনিক্যাল এনালাইসিসকে কোন প্রকার গুরুত্ব দেয়ার পক্ষপাতী নন।

পরিশেষে বলা যায় যে, ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল এনালাইসিস এর গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে দুই শিবিরের মধ্যে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, বিনিয়োগকারীগণ উভয় এনালাইসিস্ই তাঁদের নিজ প্রয়োজনের আলোকে ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষ করে কোম্পানী সিলেকশন প্রসেসে ফান্ডামেন্টাল এবং এক্সিকিউশন প্রসেসে টেকানিক্যাল এনালাইসিস ব্যবহার করার মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। বিশেষ করে যারা মধ্যম বা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করেন তাঁদের জন্য টেকানিক্যাল ও ফান্ডামেন্টাল এর সমন্বিত ব্যবহার খুবই ফলপ্রসু হতে পারে। ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করে বিনিয়োগকারী ঠিক করবে যে কোন কোম্পানীতে বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়া যাবে।

তারপর সেই কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়ে সঠিক প্রাইস না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। বাজারদর যখন কমে টেকনিক্যাল এনালাইসিসের ভিত্তিতে এন্ট্রি সিগন্যাল আসবে তখন শেয়ারটি কেনা উচিত হবে। সেক্ষেত্রে এন্ট্রি প্রাইস সম্পূর্ণ পারফেক্ট না হলেও একটু ধৈয্য ধারণ করলে কোম্পানীর মৌল্ভিত্তির কারণে ভবিষ্যতে তার দাম বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীর লোকসান হবে না। তবে দুই এনালাইসিস সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে লাভবান হওয়ার জন্য প্রয়োজন ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল উভয় এনালাইসিস সম্পর্কে বিনিয়োগকারীর সুস্পষ্ট ধারনা, অভিজ্ঞতা এবং যথাসময়ে ট্রেড এক্সিকিউট করার সক্ষমতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *